Shukti Chatterjee
B.Ed. (4th Sem)
পৃথিবীতে প্রানের সৃষ্টি হয়েছে বহু কোটি বছর আগে। তারপর মানুষের সৃষ্টির পর থেকেই মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে প্রকৃতির কাছে সমর্পিত প্রাণ। সেই সূত্রে মানুষ প্রকৃতির বাস্তুতন্ত্রের উপর ও বহুলাংশে নির্ভর শীল। বাস্তুতন্ত্র বা Ecology হল মানুষ তথা মানুষ সহ জীবিত প্রাণীর মধ্যে সম্পর্ক এবং তাদের শারীরিক পরিবেশের অধ্যয়ন। জীব বিজ্ঞানের যে শাখায় জীব ও তার পরিবেশের অন্তঃ সম্পর্ক আলোচিত হয়, তাকে বাস্তু বিদ্যা বা Ecology বলা হয়। Ecology কথাটি একটি গ্রীক শব্দ ‘Oikos’ থেকে উৎপন্ন হয়েছে, যার অর্থ হল, ‘বাসস্থান’ বা ‘বাসগৃহ’।
প্রকৃতি পূজা বলতে প্রধানত বোঝান হয় প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তি, বা প্রকৃতি কে দেবতা জ্ঞানে পুজা করা। যেমনঃ কোনো পশু, প্রাকৃতিক শক্তি বা প্রকৃতি সংক্রান্ত কোন দেবতা বা দেবীর আরাধনা করা। প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ প্রকৃতি পূজা করে আসছে। দেশ বিদেশের বিভিন্ন সভ্যতায়, ইতিহাসের পাতায়, সাহিত্যে প্রকৃতি পূজার উল্লেখ পাওয়া গেছে। প্রকৃতি সভ্যতার ধারক ও বাহক। সেই আদিম যুগ থেকেই মানুষ প্রাকৃতিক শক্তিকে ভয় পেত। বজ্রপাত, বৃষ্টি, অগ্নুৎপাত বা ভুমিকম্পকে মানুষ ভয় পেত। কালের নিয়মে আদিম মানুষ ধীরে ধীরে সভ্য হয়ে ওঠে এবং পরে বিভিন্ন সভ্যতা গড়ে তুলল। সভ্যতা গড়ে তোলার সাথে সাথে মানুষ এই প্রাকৃতিক ঘটনা গুলিকে সমীহ করে চলতে লাগল এবং সেখান থেকেই এল পুজা বাসেই সবশক্তির আরাধনার ধারনা। আমরা একটু চিন্তা করলে দেখতে পাবো, বাস্তুতন্ত্রের সাথে এই পুজা গুলির ওতপ্রোত যোগাযোগ আছে। সেই পুজা গুলি বিভিন্ন বড়ো বড়ো সভ্যতাতেও যেমন দেখা গেছে তেমনি দেখা গেছে আমাদের লোক সংস্কৃতিতেও। আসুন বড়ো বড়ো সভ্যতা গুলিতে কীভাবে প্রকৃতি পূজার প্রচলন ছিল বা বিভিন্ন ধর্মে এখনও বর্তমান তা দেখেনিই।
সেই প্রাচীন কাল থেকেই এই সভ্যতার রহস্যময়তার বিষয়ে পৃথিবীর প্রতিটা প্রান্তের মানুষ অত্যন্ত আগ্রহী। সেই উদ্দেশ্যেই মানুষ বারবার ছুটে ছুটে গেছে এই সভ্যতার খোঁজে। কেউ বলেছেন এই সভ্যতা অত্যন্ত উন্নত, আবার কারুর মতে এটি কোন সভ্যতা নয়, মানুষের অলীক কল্পনা মাত্র। বিভিন্ন বড়ো বড়ো সভ্যতার বাস্তুতন্ত্রের ক্ষেত্রে আমরা প্রকৃতি পূজার বিভিন্ন রুপও তাদের সাদৃশ্য প্রভৃতির কথা লক্ষ্য করলাম। এবার আসি আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের কথায়। আমাদের রাজ্য কৃষিভিত্তিক তথা নদীমাতৃকও বটে। গঙ্গা এখানকার প্রধান নদীও সেই নদীকে কেন্দ্র করে নদী তীরবর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ঐতিহ্য বাহীধর্মীয় আঞ্চলিক সভ্যতা। পশ্চিমবঙ্গ ঐতিহ্যও সংস্কৃতির আকর। বাঙালি, বাংলাভাষা, খাদ্য, পোশাক -পরিচ্ছদ, ধর্মীয়আচার-অনুষ্ঠান, উৎসবও তাদের সংস্কৃতি এই ঐতিহ্যকে আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে তুলেছে। পশ্চিমবঙ্গে মাতৃশক্তি পুজার চল প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে। আমরা তাই বলতেই পারি, মাতৃশক্তি / নারীশক্তির পূজা এখানে ‘প্রকৃতি’ বা ‘শক্তি’ পূজারই রুপ। সেই পূজা হিসেবে প্রথমেই যেসব দেবী দের নাম প্রথমেই বলতে হয়, তাঁরা হলেন দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী প্রমুখ। এছাড়াও বহু আঞ্চলিক দেবী বা তাদের পুজার কথা জানা যায়, যেমনঃ - ইতুপুজা, বনবিবির আরাধনা, ভাদুবাটুসুর পরব প্রভৃতি।
দুর্গা বা কালী পূজা সম্পূর্ণ রূপে প্রকৃতি ও শক্তি পূজা। তাঁদের পুজার জন্য যে উপকরন প্রয়োজন, অথবা যে বিধিমেনে এই পুজা করা হয় তার থেকেই বাস্তুতন্ত্রের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব সম্পর্কে অনেক কথা জানা যায়। এছাড়া যদি আমরা আঞ্চলিক দেব দেবী দের আরাধনার দিকে নজর দিই, তবে বোঝা যায় সেখানেও প্রচুর বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্যের উদাহরন ছড়ানো।
আঞ্চলিক দেবী হিসেবে যার কথা বলব তিনি হলেন ‘বনবিবি’। তিনিই একমাত্র আরাধ্যা দেবী যিনি হিন্দু ও মুসলিম উভয়ের দ্বারাই পুজিত হন। কিন্তু তাঁর চিত্র দুই সম্প্রদায়ের কাছে দু-প্রকার। হিন্দু সমাজে বনবিবিকে কল্পনা করা হয় একজন মাতৃমূর্তি রূপে। ক্রোড়ে তাঁর শিশু সন্তান। তিনি তপ্তকাঞ্চন বর্ণা। তিনি বিভিন্ন অলঙ্কারে এবং পুষ্প মালার সাজে সজ্জিত। মুসলিম সম্প্রদায়ে তাঁর চিত্র পরিস্ফুট হয় এক অভিজাত পরিবারের কুমারী মেয়ে রূপে। তাঁর পরিধানে থাকে অলঙ্কারাদি ওপর নেথাকে কুর্তা-পায়জামা। দুই সম্প্রদায়েই দুটি ভিন্ন ভিন্ন কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। বনবিবি বাঘের উপর আসীন থাকেন। হিন্দুরা তাকে দুর্গারই রূপ হিসেবে দেখে। বনবিবি জঙ্গলের মানুষদের আরাধ্যা। সাধারনত, সুন্দরবন অঞ্চলের জঙ্গলে তিনি পুজিত হন। শিকারি, বাউল, মাঝি, মাঙ্গলিরা তাঁকে নিয়মিত পুজা করে। যেহেতু সুন্দরবন অঞ্চল রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের বিচরণ স্থল, তাই সেই মানুশ খেক বাঘের (যাকে আসুরিক শক্তি রূপে কল্পনা করা হয়েছে) কবল থেকে নিজেদের রক্ষা করতে বহু প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ ‘বনবিবি’র পুজা করে আসছে। মনে করা হয়, ‘বনবিবি’ আরেক অরণ্যের দেবতা (যিনি দক্ষিনাংশে অবস্থান করেন ) দক্ষিণরায়কে পরাস্ত করেন।
আরেক দেবী হলেন দেবী মনসা, যিনি সর্পের দেবী। প্রধানত বর্ষাকালে দেবী মনসার আরাধন করা হয়। মনে করা হয় যে, দেবী সব সাপেদের হাত থেকে মানব জাতিকে রক্ষা করবেন। দেবীর ছারহাত এবং তিনি সাপ দ্বারাই অলঙ্কৃত। তাকে দেখা যায়, হাতে তিনি সাপ ধরে স্ব-আসনে বিরাজ মান। তিনি পদ্মাসনা, প্রতীকী অর্থে সাপএবংপদ্ম উভয়েই প্রজনন ও জীবনের (জন্মের) প্রতীক। পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত প্রাচীন কাব্য সাহিত্য ‘মনসা মঙ্গল’ কাব্য থেকে আমরা জানতে পারি, মা মনসা হলেন একজন আঞ্চলিক দেবী, যিনি চাঁদ সদাগর বনিকের পুজার দ্বারা নিজের পুজার প্রচলন করেছিলেন। চাঁদ সদাগর ছিলেন শৈব বনিক। কিন্তু মনসা যেহেতু আঞ্চলিক (আদিবাসী) দেবী সেই কারণে তিনি তাঁর পুজায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। কিন্তু ঘটনা চক্রে তাঁর নিজের পুত্রের জীবনের স্বার্থে তিনি মনসা পুজায় ব্রতী হন। মনসা ও শিবের কন্যা রূপে নিজের পরিচিত ও পুজিত হতে থাকেন। যদিও প্রথমে দেবীর আচরণে প্রতি শোধ স্পৃহা লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু শেষে দেবী মাতৃ মূর্তি রূপে প্রকট হন ও সকলের দুঃখ দুর্দশা দূর করেন। এই কাহিনীই প্রমাণ করে, এই সব কাব্যের বিভিন্ন পুরাণ কথন গুলি কতটা বাস্তু তান্ত্রিক ও বাস্তব মুখী।
বাংলার বিভিন্ন আঞ্চলিক ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান বা উৎসব গুলি অত্যন্ত বাস্তুতান্ত্রিক ও প্রকৃতি পরায়ন। তাই সেই দেবদেবীরা ও প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান উপকরণ প্রভৃতিতে নানা ভাবে আরাধ্যা দেবী বা আরাধ্য দেবতা রূপে স্থান পেয়েছেন জনগন মনে। বহু বছর আগে বসন্ত (তা ছাড়া হাম, বেদনাদায়ক ফোড়া ইত্যাদি ) বা যাকে আমরা এখন Pox রূপে জানি সেটি মহামারী আকার ধারন করত। গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। সেই সময় মানুষ এর হাত থেকে বাঁচতে মা শীতলার আরাধনা শুরু করে। তাঁরা মনে করত যে, দেবীর আরাধনায় এই রোগের থেকে মুক্তি লাভ সম্ভব। আসলে এই পুজায় দেবী কে তুষ্ট করার জন্য মানুষেরা যে যে উপকরণ বা উপাচার সহকারে দেবীর পুজা করতেন, সে গুল মানুষের বসন্ত রোগ উপশমে সাহায্য করত। দেবী রাসভের পিঠে অধিষ্ঠান করছেন, ডান হাতে তাঁর সম্মার্জনী এবং বাম হাতে একটি কলসি থাকে। দেবী শুভ্রবর্ণা ও ত্রিনয়না এবং অলঙ্কারে ভূষিতা। পুরাণ অনুযায়ী, দেবীর সঙ্গী হলেন জ্বরাসুর, যিনি জ্বর (রোগ) ও দৈত্যের রূপ। এ রকম মনে করা হয় যে, দেবী নবদুর্গার একরূপ কাত্যায়নীরই স্বরূপ, যিনি সমস্ত রোগ, দুঃখ-কষ্ট, বেদনা প্রভৃতি থেকে মানুষকে মুক্তি দেন। হোলির আট দিন পর এই দেবীর পুজা করা হয়। তাঁকে একজন সুন্দরী, যুবতী রূপেই কল্পনা করা হয়, যিনি নীল বস্ত্রে ভূষিতা। তাঁকে ‘দেবী’ বা ‘মা’ রূপে কল্পনা করা হয়, অর্থাৎ, তিনিও মাতৃ মূর্তি যিনি তাঁর সন্তান দের বিপদ নাশিনী।
প্রসঙ্গত আরও এক দেবীর কথা মনে পড়ছে, তিনি হলেন চণ্ডী, যিনি বাংলা লোক সংস্কৃতিতে চণ্ডীকে ধরা হয় ‘ভাগ্যের’ দেবী রূপে। ‘চণ্ডী’ কে বিভিন্ন রূপে পুজা করা হয়। নিম্নে তাঁদের কিছু বর্ণনা দেওয়া হল –
‘ওলাই চণ্ডী’ হলেন সেই দেবী যিনি কলেরা প্লেগ বা গবাদি পশু দের বিভিন্ন রোগের উপশম করেন বলে মানুষের বিশ্বাস।
‘জয় চণ্ডী’ হলেন দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার জয়নগরের আরাধ্যা দেবী। এই অঞ্চলের মানুষের বিশ্বাস অনুযায়ী ইনি পাথরের মূর্তি রূপে মাটি ফুঁড়ে উত্থিত হয়েছেন ও তিনি ধন ও ঐশ্বর্যের দেবী।
শিশু দের শারীরিক সুস্থতা ও মঙ্গল কামনায় ‘মঙ্গলচণ্ডী’র পুজা করা হয়।
হুগলী জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে বৈশাখের সংক্রান্তি তে এই দেবী ‘বড়াইচণ্ডী’র পুজা করা হয়। দেবীকে কোনো মূর্তি রূপে কল্পনা করে পুজা করা হয় না, বরং তিনি পুজিত হন পাথর রূপে, যিনি মা জগদ্ধাত্রীর রূপ বলে কল্পনা করা হয়। ‘মঙ্গলকাব্য’ অনুযায়ী, শ্রীমন্ত সদাগর তাঁর আরাধনা করেছিলেন তাঁর বাবাকে সিংহলের (অধুনা শ্রীলঙ্কা) কারাগার থেকে মুক্ত করেছিলেন ও দেবীর আরাধনায় ব্রতী হন। দেবী বড়াই চণ্ডী জয় ও শক্তিরদেবী।
আরও একজন অতি পরিচিত লোক সংস্কৃতির দেবী হলেন ‘মা ষষ্ঠী’। যিনি শিশুদের জন্ম ও শিশুদের রক্ষা কর্ত্রী। ষষ্ঠী ঠাকরুন উর্বরতার দেবী। দেবী ষষ্ঠীকে পুজা করা হয় বটগাছ রূপে, অথবা মাটির পাত্র রূপে। দেই মাটির পাত্র মাতৃ জঠর বা প্রজনন বা উর্বরতার প্রতীক।
এছাড়াও অগ্রহায়ণ মাসে টুসু (যা কে লক্ষ্মী রূপে ) পুজা করা হয়, কার্ত্তিক মাসে ইতু ( সূর্যরূপে) পুজা করা হয়, ভাদ্র মাসে ভাদুর পরব পালন করা হয় পুরুলিয়ায়, এই সব দেবী ছাড়াও আমাদের রাজ্যে অনেক আঞ্চলিক দেবতারও পুজা করা হয়, যেমনঃ- দক্ষিণরায়, পঞ্চনন্দঠাকুর, ভৈরব, ভীম, বড়ঠাকুর, বলরাম প্রমুখ। মানুষ তাদের ধর্ম বিশ্বাসের সাথে বাস্তুতন্ত্রকে মিলিয়ে সমাজ ও সমাজের মানুষদের উপকারী পুজা ও তার জন্য প্রয়োজনীয় আচার-অনুষ্ঠান তৈরি করেছে। যা মানব সমাজের অনুকূল। এই ভবেই বাস্তুতন্ত্রের সাথে প্রকৃতি পূজা অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত।