মহুয়া চ্যাটার্জী চক্রবর্তী
B.Ed. (2nd Sem)
প্রচন্ড গরমে শান্তিনিকেতনের লাল মাটি গনগনে আগুনের মত হয়ে উঠেছে। মাঝেমাঝে মাটি থেকে পাক খেয়ে উঠছে ছোট ছোট ঘূর্ণির মত ধুলোর ঝড়। বাঁধা ছাঁদা চলছে। এবারের গন্তব্য পারস্য, ইরান, ইরাক প্রভৃতি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি। এমনতো সারাজীবনে কতবারই ঘটেছে। কিন্তু আজ একটা বিশেষ কারণে কবি কিছুটা অন্য মনস্ক। কিছুদিন আগে কলকাতায় চিত্রা থিয়েটারে মুক্তি পেয়েছে তাঁর অভিনীত এবং নির্দেশিত ছায়াছবি ‘নটীরপূজা’। নিউ থিয়েটার্সের বীরেন্দ্রনাথ সরকার গত বছর জন্মোৎসবে ‘নটীরপূজা’ মঞ্চে দেখার পর থেকেই ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন এটিকে সিনেমায় রূপদান করার। কিন্তু আজ সেটা বাস্তবায়িত হলেও বাণিজ্য সফল হতে পারল না ।
চলে আসি পাঁচ বছর পর। সময়টা ১৯৩৭। ছবির নাম ‘মুক্তি’। প্রমথেশ বড়ুয়া, কানন দেবী অভিনীত ছবিতে প্রথম বার রবীন্দ্রনাথের লেখা গান ব্যবহার করা হল। ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’। যদিও এর সুরা রোপ করলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক। অবশ্যই কবির সম্মতিতে।
সিনেমার পর্দা উঠল এইভাবেই। কবির সম্মতি তো ছিলই, সেই সঙ্গে যোগ হল রবীন্দ্রগানের সঙ্গে আপামর বাঙালির জড়িয়ে থাকা জীবন বোধের এক নিখুঁত সমণ্বয়। ঋত্বিক ঘটকের কোমল গান্ধার ছবিতে ব্যবহৃত একটি গান এ প্রসঙ্গে প্রথমেই মনে পড়ে। শিলং পাহাড় এর লোকেশনে শুট করা ছবির দৃশ্য, যেখানে অভিনেতা অনিল চ্যাটার্জীর দুরন্ত অভিনয়ের সঙ্গে দেবব্রত বিশ্বাসের সতেজ কণ্ঠের উচ্চারণ যেন মুহূর্তের মধ্যেই এক বিশ্বাস জাগিয়ে তোলে। বলে ওঠে – বিস্ময়ে তাই জাগে আমার প্রাণ –
‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’ গানটির এমন প্রতিরূপ আর কোথাও পেয়েছি কি আমরা?
চলে আসি ১৯৬১ তে।
রবীন্দ্রনাথের শত বর্ষে নির্মিত তথ্যচিত্রটির ভূমিকায় সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন-
“On the 7th of August, 1941, in the city of Calcutta, a man died. His mortal remains perished but he left behind him a heritage; which No Fire could consume. It is a heritage of verse and music and poetry of ideas and of Ideals and it has the power to move us to inspire us today, and the days to come. We who owe him so much salute his memory”.
তাই তাঁর ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার একটু আলাদা রকম। কখনো চারুলতা ছবিতে দেবর বৌ-ঠাকুরানীর রসিকতার মাধ্যম হিসেবে (আমি চিনি গো চিনি তোমারে), কখনো মনিহারা ছবিতে নায়িকা মনিমালিকার তীব্র সুপ্ত ইচ্ছার সঙ্গে আসন্ন সংকটের পূর্বাভাস দিতে (বাজে করুণ সুরে), অথবা কখনো আগন্তুক ছবিতে শিক্ষিতা গৃহবধুর অন্তর্দ্বন্দ্বের রূপায়ণ করতে (বাজিল কাহার বীণা)।
একবার এক সাক্ষাৎকারে পরিচালক তপন সিংহ বলেছিলেন, ‘গান আমার কাছে বন্ধুর মতো’। নিজের যে ছবিতে প্রথম সংগীত পরিচালক রূপে তাঁকে আমরা পাই–সেটি হলো অতিথি। রবীন্দ্রনাথের গল্প। উদাসী কিশোর তারাপদ চরিত্র-টিকে এক লহমায় বেঁধে ফেলেছে যে গান, সেটি হলো – এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়। মনে পড়ে প্রথম দৃশ্যে বিস্তীর্ণ প্রান্তর এর ছবির মধ্যে ফুটে ওঠা চরিত্রের সঙ্গে নেপথ্যে বেজে ওঠে এই গানের সুরটি। যাকে ক্রমে পূর্ণ করে দেয় তারাপদ’ র চরিত্রাভিনেতা পার্থ মুখোপাধ্যায়ের কিশোর কণ্ঠে গাওয়া গান –ধরা দিয়েছি গো আমি আকাশের পাখি।
তপন সিংহের পরিচালনায় নির্জন সৈকতে ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৬৩ সালে। পুরীর পটভূমিকায় নির্মিত এই ছবিটিতে মিশে গিয়েছে রচয়িতা কালকূটের জীবন দর্শন। তারই প্রতিফলনে যেন একটি গান হয়ে উঠেছে এই ছবির যাকে বলে Theme Song – পথ দিয়ে কে যায় গো চলে। অন্যদিকে বনফুলের ‘হাটেবাজারে’ গল্পের রূপায়ণে পাই একমরমী চিকিৎসকের আত্মদর্শন। মানবিক চেতনা সমৃদ্ধ এই ছবিতে কবিতাও গান পাশাপাশি চলেছে তপন সিংহের অনবদ্য শিল্প বোধের সমণ্বয়ী পরিকাঠামোয়।
‘ওগো নদী আপন বেগে’ গানে যেমন অভিব্যক্ত হয়েছে কিশোর চরিত্র গুলির সারল্য, যা ছবিটির এক ঋজু অবলম্বন।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে, উত্তমকুমার –অরুন্ধতী দেবী অভিনীত বিচারক ছবিটি মুক্তিপায় ১৯৫৯ সালে প্রভাত মুখার্জীর নির্দেশনায়। ছবিতে তরুণ ব্যারিস্টার উত্তমকুমারকে একটি রবীন্দ্র গানের চিত্রায়ণে সাইকেল নিয়ে বেসামাল হতে দেখতে বেশ মজাই লেগেছিল। উৎপলা সেনের ব্যতিক্রমী কণ্ঠে সেই গান, ‘ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে’ স্মরণে থেকে যাবে চিরদিন।
৭০ থেকে ৮০ এবং নব্বইয়ের দশকের বাংলা চলচ্চিত্রে রবীন্দ্র সঙ্গীত এল তরুণ মজুমদারের হাত ধরে। শ্রীমান পৃথ্বীরাজ, নিমন্ত্রণ, দাদারকীর্তি, ভালোবাসা ভালোবাসা, আলো আরো কত ছবি। বলা যায়, বাংলার বাণিজ্যিক ছবির জগতে রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রয়োগ এবং প্রসার ঘটালেন তিনি। বাণিজ্য সফল এই ছবি গুলি ধরে রেখেছে রবীন্দ্রগানের অসংখ্য ভক্তদের। সখী ভাবনা কাহারে বলে, যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন, দূরে কোথায় দূরে দূরে, চরণ ধরিতে দিয়োগো আমারে, শ্রাবণের ধারার মত পড়ুক ঝরে, আরও অসংখ্য এমন মন ছুঁয়ে যাওয়া গান এ ছবি গুলির অনন্য সম্পদ।
সলিল সেন পরিচালিত ‘মন নিয়ে’ ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৬৯ সালে। মানসিক অসুস্থতার শিকার যমজ দুই বোনের এক বোনকে নিয়ে এক জটিল কাহিনীর সূচনায় সুচারু ভাবে মিশে গিয়েছিল একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত। সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। জনপ্রিয় এই ছবিটিতে মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন উত্তমকুমার এবং সুপ্রিয়াদেবী। জনপ্রিয় আধুনিক গানের সঙ্গেই মানুষ মনে রেখেছে রবীন্দ্রনাথের “আমি পথ ভোলা এক পথিক এসেছি” গানে উত্তম-সুপ্রিয়ার মন কাড়া অভিনয়। Landmark হয়ে যা রয়েগেছে আজ পর্যন্ত।
ঋতুপর্ণ ঘোষ। রবীন্দ্রমনণের, রবীন্দ্র আত্তীকরণের এক দৃঢ় নির্মোহ প্রতিফলন। তাঁর ছবিগুলিতে প্রযোজ্য এক একটি রবীন্দ্রগান এর সাক্ষ্যদান করে। প্রথম ছবি হীরের আংটিতে নেপথ্যে বেজে ওঠা - ‘শরতে আজ কোন অতিথি’ থেকে ‘চিত্রাঙ্গদা’ ছবির শেষ দৃশ্যে ‘নূতন প্রাণ দাও’ পর্যন্ত। বলা বাহুল্য ছবি গুলির প্রাণ বাঁধা আছে এই গান গুলির মধ্যে। মনে পড়বে ‘উৎসব’ ছবিতে যন্ত্রানুষঙ্গ ব্যাবহার না করে, শ্রাবণী সেন এর খোলা গলায় গাওয়া “অমল ধবল পালে লেগেছে” গানটি। অথবা শুভ মহরত ছবিতে মনোময় ভট্টাচার্যের গাওয়া “জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে”।
রবীন্দ্রনাথের গান চলচ্চিত্রে সার্থক রূপায়ণ করেছেন যাঁরা, তেমনই একজন ব্যতিক্রমী পরিচালক হলেন অপর্ণাসেন। তাঁর পরিমিতি বোধ, নান্দনিক দৃষ্টি ভঙ্গি রবীন্দ্রগানের অধরা মাধুরীকে ছুঁতে পেরেছে ছবির পর্দায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, পারমিতার একদিন ছবির একটি গান - ‘তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায়’। একটি মাত্র গানের প্রয়োগেই যেখানে ছবিটির মূলচরিত্র গুলি ঘটনা পরম্পরায় একসূত্রে গাঁথা হয়ে গিয়েছে। আর শেষে মানসিক ভাবে অসুস্থ খুকুর অস্তিত্ব হয়ে উঠছে এই বিশেষ গানটি।মর্ম স্পর্শী যে গান, এই ছবির সামগ্রিক উদ্দেশ্য কে প্রকাশ করেছে ছবির শেষ দৃশ্যে- তা হল, প্রবুদ্ধরাহার কণ্ঠেগীত, বিপুল তরঙ্গ রে। সার্থক এই রূপায়ণ।
আচার্য সুকুমার সেন বলেছিলেন, রবীন্দ্র গানের চতুর্মাত্রিকতার কথা। তুলনা করেছিলেন “মোটর গাড়ি নয়, এরোপ্লেন” এর সঙ্গে। বস্তুত এই বৈশিষ্ট্যটির জন্যই রবীন্দ্রগানের অসংখ্য প্রয়োগেও আজও তার দ্যুতি অমলিন।
১৯৩২ এ মুক্তিপ্রাপ্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অভিনীত নটীর পূজা চলচ্চিত্রটির আজ আর কোনো print পাওয়া যায়না। তার কারণ, একবার এক বিধ্বংসী আগুনে নিউথিয়েটার্স স্টুডিওর অনেক অমূল্য সম্পদের সঙ্গে এটিও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কিছু স্থিরচিত্র আছে। আর আছেন রবীন্দ্রনাথ। আমাদের জীবনে, মনে, প্রাণবায়ুতে এবং অবশ্যই সিনেমায়।