শিলাদিত্য হাজরা
বর্ষ- ২য় সেমিস্টার- ৪র্থ রোল নং- ৫৬ কোর্স- বি.এড. ২০২১-২৩
সতুদাকে আদিলের বড়ো ভালো লাগে। বেশ সাধাসিধে একজন ফ্যামিলিম্যান। মনে কোনো মারপ্যাঁচ নেই। সদাহাস্য আর কৌতুকপূর্ণ একজন মানুষ। ভীষণ পাংচুয়াল, ঘড়ির কাঁটার মতো তাঁর জীবন চলে।একেবারে সাড়ে ন'টায় আপিসে ঢোকেন। দেড়টা অবধি টানা কাজ করেন। ঠিক দেড়টায় সাদা-গোলাপি রঙের একটা ডাব্বা নিয়ে ক্যান্টিনে যান টিফিন করতে। দুটো পাঁচে বাড়িতে একটা ফোন করেন। দুটো পনেরোতে আবার এসে কাজে বসেন। পাঁচটায় চা আর স্ন্যাক্স খেতে যান। সেটা শেষ হলে বাড়িতে আবার একটা ফোন করেন। পাঁচটা পনেরোতে ফিরে ছ'টা অবধি আবার টানা কাজ। তারপরে ওঁনাকে আর আটকে রাখা যাবেনা। এই ওঁনার প্রতিদিনের রুটিন। আপিসের লোকেরা ওঁনার পিছনে 'ওয়াচম্যান' বলে ডাকে। এই 'ওয়াচ' মানে নজরদারি অবশ্য নয়, এর মানে 'ঘড়ি'।
আদিল চারমাস হল এখানে কাজে ঢুকেছে। এরমধ্যেই ওর ও বাকিদের মতো সতুদাকে দেখে সময় বুঝে নেওয়ার অভ্যাস হয়ে গেছে। কাজের চাপে ঘড়ির দিকে তাকানোর সময় হয়না। সতুদা ওরফে সত্যেন্দ্রদাকে দেখে সময়ের গতিবিধি বুঝে নেয়।
সত্যেন্দ্র বাগচী মার্কলাইন শিপিং কোম্পানিতে আজ প্রায় আঠাশ বছর কাজ করছেন। ছাব্বিশ বছর বয়সে এখানেই তিনি প্রথম কাজে ঢোকেন। কোম্পানির মালিক একবার বদল হয়ে গেছে কিন্তু সতুদা এখনও এখানেই টিকে আছেন।
কি-বোর্ডে 'এস' বাটন টা কাজ করছিল না বলে আদিল তাতে চার-পাঁচবার চাপ দিল। তাতেও কোনো লাভ হল না দেখে মুখ তুলে সতুদার দিকে তাকাল।
চোখে রিমলেস চশমা, গায়ে হালকা রঙের সবুজ শার্ট। পরশুদিনও এটাই পরে এসেছিলেন উনি। বললেন, ওঁনার ছেলে নিউইয়ারে কিনে দিয়েছে। আদিল লক্ষ্য করেছিল, বলতে বলতে ওঁনার চোখ দুটো খুশিতে ঝলমল করছিল। ও একটু অন্য মনস্ক ভাবে হেসেছিল। ওরও ইচ্ছে ছিল চাকরিতে ঢুকে আব্বুকে পাঞ্জাবি কিনে দেবে। কিন্তু সে সুযোগ সে পায়নি। বছর চারেক হল আব্বু মারা গেছেন।
সতুদার চোখের মণিদুটো কম্পিউটারের আলোয় নীল। মগ্ন হয়ে ডুবে আছেন কাজে।
আদিল ঘড়ি দেখল। লাঞ্চ ব্রেক হতে এখনও পনেরো মিনিট দেরি।
"আদিলমেলটাপাঠিয়েছ?" একটু দূরের কম্পিউটার থেকে সায়নের আওয়াজ শুনে সেদিকে ঘুরে আদিল বলল, "এখনও না। কি-বোর্ডটা.."
"আরে তাড়াতাড়ি পাঠাও। বসে থাকলে হবে। সকালে মেল করেছিল ওরা। তিনটে বাজতে চলল, এখনও তোমার রিপ্লাই করা হল না।"
আদিলের কথা না শুনেই সায়ন অনেকগুলো কথা বলে দিল। ওটা ওর স্বভাব। ইয়াং এমপ্লয়িদের মধ্যে ও সবচেয়ে বেশি সময় ধরে আছে আর কম্পিউটারটা একটু ভালো জানে বলে এমন ভাব দেখায় যেন ও মালিকের ঠিক পরেই। আর সবকিছুই বাড়িয়ে বলতে হবে তাকে। সতুদা এখনও লাঞ্চেই গেল না, আর নাকি তিনটে বাজে। কুছভি!
নিজের মনে এসব ভাবতে ভাবতে কম্পিউটারের দিকে ঘুরতে গিয়েই আবার তার চোখ পড়ল সতুদার দিকে। সতুদা তার দিকেই তাকিয়ে হাসলেন। তারপর খুব নরম গলায় বললেন,"এস কাজ করছেনা?"
আদিল হাঁ হয়ে গেল। কোনকি-বোর্ডের এস কাজ করেনা এটাও উনি জানেন? একটা বিস্ময়ের হাসি দিয়ে বলল,"হ্যাঁ। কি করে বুঝলেন?"
"দেড় বছর ধরে ওই কি-বোর্ডের..." একটা ঢেঁকুর তুলে বাকিটা শেষ করলেন,"ওইহাল। এস-র বোতাম টা খুলে আবার লাগাও। কাজকরবে।"
আদিল তাই করল এবং সত্যি তাতে কাজ হল।এটা অবশ্য প্রথম বার না, সতুদা তাকে অবাক করেছেন। এইতো গত সপ্তাহে ২০১৬-র একটা ফাইল বসের দরকার পড়েছিল।সাত বছরের পুরোনো ফাইল কোন ড্রয়ারে আছে সেটা অবধি বলে দিয়েছিলেন উনি।
মেল পাঠানো শেষ হলে উঠে পড়ল আদিল। সতুদার টেবিলে এগিয়ে গিয়ে বলল,"থ্যাঙ্কইউ। লাঞ্চকরবেননা?"
"এই যাবো। পিক আপ অর্ডার টা শেষ করেনি।" সত্যেন্দ্রবললেন।
"কোথাকার?"
"ফেলিক্সটো।"
কাজ শেষ হতে ব্যাগ থেকে ডাব্বা বের করে সত্যেন্দ্র বললেন,"চলো।"
ক্যান্টিনটা দোতলায়; ওদের এক তলা নেমে আসতে হয়। ক্যান্টিনে বসে টিফিন বক্স খুলতে খুলতে আদিল বলল, "কি এনেছেন আজকে?"
"লুচি আর ঘুগনি।"
"ওয়াও!!"
"নেবে একটা?"
" না না আপনি খান।"
"আরে নাও। নাও।আমার মিসেসের হাতে বানানো। খেয়ে দেখ কেমন করেছে।"
সতুদার তুলে দেওয়া একটা লুচি ঘুগনিতে ডুবিয়ে মুখে দিতেই আদিলের মনে হল, এ সত্যি অমৃত। একটা তৃপ্তির আওয়াজ করে বলল, "সত্যি সতুদা। তুমিলাকি। এ রকম রান্না বৌদির।"
হাসি মুখে সত্যেন্দ্র মুখে লুচি পুড়লেন।
"আপনার ছেলে কিসে চাকরি পেয়েছে?"
"বস্কো ইন্টারন্যাশনাল নামের একটা কোম্পানিতে। চৌকস ছেলে। একশো একাত্তর র্যাঙ্ক করেছিল আই.আই.টি. এন্ট্রান্সে।"
"বাঃ! ফ্যান্টাস্টিক।"
"নতুন ফ্ল্যাট কিনেছে। গাড়ি কিনেছে।" একটু ঝুঁকে এলেন সত্যেন্দ্র ,"তোমার বৌদির কাছে শুনলাম, অফিসের একটা মেয়েকে নাকি বাবুর পছন্দ হয়েছে।"
কথাটা শেষ করে যে হাসি টা দিলেন সতুদা তার দাম লাখ টাকা। আর সত্যি বলতে গর্ব করার মতোই জীবন।
"তা তোমার বাড়িতে আর কে কে আছে?"
"বাবা মারা গেছেন অনেক ছোট বেলাতেই। মা আছেন। মিসেস, ছেলে মেয়ে, ভাই আর ভাইয়ের বৌ। আর আমার এক ভাইপো।"
"পৈতৃকবাড়ি?"
"খাঁটি। তিন পুরুষের বাস এখানে আমাদের।"
"মেয়ে কি করে?"
"ও এই ক্লাস টুয়েলভে উঠল। এবার আই.এস.সি. দেবে। তারপর মেডিকেলে বসবে বসবে করছিল। দেখা যাক কি হয়।"
"হয়ে যাবে। টেনশন করবেন না। দাদা যখন এত ব্রিলিয়ান্ট, বোনেরও হবেই।আর আপনার ছেলে ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করছে। বোনের দায়িত্ব তো সেই নিতে পারবে।"
"সে নেয়। গতবার পুজোয় বোনের জন্য এত্ত জামা কাপড় কিনলো।" খেতে খেতে হাত দুটো চওড়া করে পরিমাণটা বোঝালেন সত্যেন্দ্রদা। তারপর বললেন,"আর আমার ভাইপোটাকে যদি দেখ। এত ডানপিটে। অবশ্য আমার ভাইও ছোটবেলায় ডানপিটে ছিল।"
বলতে বলতে হেসে ফেললেন সতুদা। বোঝা গেল, ছোটবেলার কোনো স্মৃতি মনে পড়ে গেছে। বললেন,"ছোটবেলায় আমাদের গ্রামের স্কুলে, ভূগোলের স্যার ছিলেন মানিকবাবু। বেদম বদ মেজাজি। একদিন আবির, মানে আমার ভাই, ক্লাসে পড়া পারল না। বেজায় মারখেল। তারপর তার কি রাগ। মানিকবাবুকে জব্দ করতেই হবে। মাঝরাতে উঠে, ওঁনার বাড়ির গোয়ালে ঢুকে ওঁনারই গরুর গোবর নিয়ে বাড়ির দরজার হাতলে, উঠোনে, জানলায় যেখানে পারল গোবর মাখিয়ে এল। পরদিন গন্ধে সে বাড়ির পাশে টেকা দায়...সরি।"
শেষের কথাটা অবশ্য হাসির চোটে লুচির ছোট্ট একটা টুকরো মুখ থেকে বেরিয়ে টেবিলে পড়ায়।
"তার ছেলেতো ডানপিটে হবেই। তবে আমাকে খুব ভালোবাসে। বাবার কাছে বকা খেলেই জেঠুর কাছে এসে লুকোবে।"
ভাত চিবোতে চিবোতে আদিল বলল,"কোন ক্লাসে পড়েসে?"
"নাইন চলছে। টেনে উঠবে এবার।"
সত্যি বলতে আদিলের একটু হিংসে হচ্ছিল। ও মনে মনে ঠিক এরকমই একটা পরিবার চাইত। সবাই মিলে হেসে খেলে থাকবে। কিন্তু বাড়িতে শুধু মা আর বোন। মা বাড়ি বাড়ি কাজ করে, আর বোনটা সরকারি স্কুলে পড়ে। আদিলের এই চাকরিই তাদের একমাত্র ভরসা।
সতুদাকে আসতে বলবে একদিন ওদের বাড়িতে? আদিলের মনে ইচ্ছে করছিল ডাকার। অফিসের কাউকে ও কোনোদিন ওর বাড়িতে ডাকেনি। এর আগে যখন ও দু'বছর টিউলিপ শিপিংয়ে কাজ করেছিল, তখনও না। ওর ওই ছোট্ট একচালার ঘরে কাউকে কখনও ডাকা যায়? কিন্তু মনের ভেতর ইচ্ছে ছিল বরাবরই। সবাই তাদের বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠানে কলিগদের ডাকে, বাড়ির সবার সাথে আলাপ পরিচয় করায়।
ইতস্তত করতে করতে আদিল বলেই ফেলল, "একদিন আসুন না আমাদের বাড়িতে। মা আছে, বোন আছে। আলাপ করিয়ে দেব।"
হাসলেন সত্যেন্দ্র, "খুব ভাল লাগল, তুমি ডাকলে যে। যাব 'খনে একদিন। কিন্তু কি জানোতো ভায়া, এই অফিসের সময়টুকু বাদ দিয়ে বাকি সময় আমি শুধু ফ্যামিলির জন্য দি।"
আদিল বলতে গেল, 'কালই চলুন না।' কিন্তু আটকে গেল। মায়ের ওই জীর্ণ শাড়ি, বোনের ওই মলিন হয়ে যাওয়া ফ্রক, সবুজ দেওয়ালে তেল চিটে পড়ে কালচে রং, নাই বা দেখাল এগুলো সতুদাকে। সঙ্কোচ কাটিয়ে বলে ফেলছিল বটে কিন্তু বাড়ির ওই জীর্ণ দশা প্রকাশ্যে আনতে তার লজ্জা করছিল।
'থাক না, কি দরকার। ভদ্রতার খাতিরে বলেছি। সতুদা যেমন ফ্যামিলি পাগল, মনে হয় না আসবেন বলে। ছটা বাজলেই তো উনি বাড়ির দিকে দৌড়োন। উৎসাহ তো কিছু দেখালেন না সেভাবে।'
এসব আকাশ-পাতাল ভাবনার মাঝে ক্যান্টিনে এসে ঢুকল সায়ন, মৌনী আর আকাশ। দূর থেকে সায়নের গলা এল, "সতুদা। ছাব্বিশে জানুয়ারি, পিকনিক হচ্ছে। জোকা-রদিকে যাবো। আপনিযাবেন?"
হেসে উত্তর দিলেন সত্যেন্দ্র, "তুমি তো জানো আমি যাই না।"
"আরে চলুন, চলুন।বৌ-বাচ্চা তো থাকবেই। রোজই তো ওদের জন্য সময় দেন। একদিন আমাদের সাথে চলুন।"
আবার হাসলেন সত্যেন্দ্র, "তানয়। আমরা ওই দিন পিকনিকে যাচ্ছি। বাড়ির সবাই মিলে। এক সাথে দু'জায়গায় কিভাবে যাই বলো।"
"দুটো রুটি আর তরকারি কি আছে?" সত্যেন্দ্রর কথার উত্তর না দিয়ে সায়ন ক্যান্টিনের ছেলেটার সাথে কথা বলতে শুরু করল।
"আলুর দম আছে। চিকেন করেছি আজকে। "ছেলেটা উত্তর দিল।
"আরে কি তোমরা চিকেন করো। মাংস খেতে হয় মটন। যাকগে, দুটো রুটি আর একটা আলুর দম দিয়ে যাও।"
অর্ডার শেষ করে সতুদাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "ঠিক আছে সতুদা। তাহলে চাঁদাটা দিয়ে দেবেন।"
"কত দিতে হবে বোলো। কালকে দিয়ে দেব।"
আদিলের ছেলেটাকে একদম পছন্দ না। বড্ড বেশি অ্যাটিটিউড দেখায়।
খাওয়া শেষ করে বাক্স বন্ধ করতে করতে সত্যেন্দ্র বললেন, "উঠলাম হে ভায়া। বাড়িতে একটা ফোন করতে হবে।"
*****
এই সতুদার যে এমন হবে কে ভেবেছিল?
লাঞ্চ থেকে ফিরে এসে কাজ করতে করতে অফিসের চেয়ার থেকে আচমকাই পড়ে গেলেন হুমড়ি খেয়ে। বুক চেপে ধরে কিছুক্ষণ শ্বাস নেবার চেষ্টা করলেন। আদিল যখন দৌড়ে এল তাঁর পাশে তখন তিনি সংজ্ঞা হারিয়েছেন।
আদিল গালে আলতো আলতো চাপড় মেরে ডাকল, "সতুদা। সতুদা।"
অফিসের বাকি স্টাফরা ঘিরে ধরেছে চারপাশে। আদিল তাদের দিকে ঘুরে বলল, "জল,একটু জল।"
মুখে জলের ছিটে দিল কিন্তু সতুদার জ্ঞান ফিরল না। নাড়ি দেখে বোঝা গেল তিনি বেঁচে আছেন। আকাশ বলল,"ওঁনাকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে।"
ভেতরের অফিস থেকে ওদের মালিক সায়ক ব্যানার্জি বেরিয়ে এসেছেন। উনিই বললেন, "আকাশ, তুমি তোমার গাড়িতে ওঁনাকে নিয়ে এক্ষুণি মেডিকেল কলেজে চলে যাও। আদিল,তুমি আকাশের সাথে যাও।"
সত্যেন্দ্রদা কে ধরা ধরি করে গাড়িতে তোলা হল। এসপ্ল্যানেড থেকে মেডিকেল কলেজ দশ মিনিটের রাস্তা। আড়াইটের সময় জ্যামটা কম থাকায় সাত মিনিটে ওরা এমার্জেন্সির সামনে গাড়ি নিয়ে ঢুকল।
সতুদাকে আবার ধরা ধরি করে স্ট্রেচারে শুইয়ে দিয়ে আদিল ব্যাকুল ভাবে অনডিউটি ডাক্তারের জন্য তাকাল। সামনেই একজনকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে গিয়ে বলল, "ডাক্তারবাবু, একটু দেখবেন আসুন। উনি হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছেন।"
ডাক্তারবাবু তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে নাড়ি পরীক্ষা করলেন। আদিলকে জিজ্ঞেস করলেন, "কিভাবে পড়ে গেলেন?"
"লাঞ্চকরেএসেকাজকরছিলেন।আচমকাহুমড়িখেয়েপড়েগেলেন।বুকচেপেধরেশ্বাসনেবারচেষ্টাকরতেকরতেঅজ্ঞান।"
"কোনো মেডিক্যাল হিস্ট্রি? প্রেশার, সুগার?"
"জানিনা। আমি ওঁনার অফিসের কলিগ.."
"সিস্টার।" আদিলের কথার মাঝেই হাঁক দিলেন ডক্টর। একজন নার্স এগিয়ে এসে বলল, "হ্যাঁ প্রদীপদা?"
"ডেকাড্রন, ডেরিফাইলিন। তাড়াতাড়ি।" তারপর আদিলের দিকে ফিরে বললেন, "তারপর বলুন।"
"আমি ওঁনাকে চার-পাঁচ মাস দেখছি। কোনোদিন এরকম কিছু হতে দেখিনি। একদম সুস্থ ছিলেন। সব কাজ, খাওয়া-দাওয়া সময়ে করতেন। আকাশ, তুইতো আগে থেকে দেখছিস। কিছু হয়েছে এরকম?"
আকাশ মাথা নেড়ে 'না' বলল। ইতিমধ্যে নার্স এসে দুটো ইঞ্জেকশন দিল সত্যেন্দ্রদা কে। প্রদীপ ডাক্তার বললেন, "আমি একটা এমার্জেন্সি প্রেসকিপশন বানাচ্ছি। কাউন্টার থেকে একটা ফর্ম নিয়ে ফিল-আপ করুন। ওঁনাকে অ্যাডমিট করতে হবে।"
আদিল দৌড়ে গিয়ে একটা ফর্ম তুলে নিয়ে ফিল-আপ করল। ফোন নাম্বারে নিজের নাম্বার টাই দিল কারণ সত্যেন্দ্রদার বাড়ির কারোর নাম্বার ওর কাছে ছিলনা।
ফর্ম নিয়ে ডাক্তারের কাছে ফেরত দিতে তিনি বললেন, "ওঁনার কার্ডিয়াক অ্যাটাক হয়েছে। আমি কার্ডিওলজি ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ফ্রি বেড কিন্তু খালি নেই।"
"কোনো অসুবিধা নেই। "তারপর আকাশের দিকে ঘুরে বলল, "তুই একটু দুশো টাকা দিয়ে দিতে পারবি? আমি তোকে পরে দিয়ে দেব।"
"আরে ঠিক আছে, ওটা কোনো ব্যাপার না। "আকাশ বলল।
ডাক্তারবাবু আদিলের দিকে তাকিয়ে বললেন, "আপনি তাহলে ওঁনার সঙ্গে যান। পেশেন্টের ঘড়ি, মোবাইল যা আছে, আপনাকে দিয়ে দেবে।" তারপর আদিলের উদ্বেগ দেখে কাঁধে হাত রেখে বললেন, "প্যানিক করবেন না। ইঞ্জেকশন দিয়েছি। ভরসা রাখুন।"
কি বলবে বুঝতে না পেরে, কয়েক সেকেন্ড ভেবে আদিল বলল, "ভরসা রাখব।"
এমার্জেন্সি থেকে কার্ডিওলজি ওয়ার্ডে সতুদাকে নিয়ে গেল নার্সরা। ওয়ার্ডে ঢোকার মুখে আদিলকে বলল, "আপনি এখানে ওয়েট করুন।"
আদিল দাঁড়িয়ে পড়ল। একটু পরে নার্স সতুদার মোবাইল,রিস্টওয়াচ, মানিব্যাগ, কিছু খুচরো কয়েন আর শার্ট-প্যান্ট গুলো একটা প্যাকেটে ভরে আদিলের হাতে দিয়ে গেল। যাওয়ার সময় বলে গেল, "হাউস স্টাফকে কল দিয়েছি। আপনি ওঁর বাড়িতে ততক্ষণ কল দিন। ছ'টার পর সিনিয়র হাউস স্টাফ আপনার সাথে বা ওঁর বাড়ির কেউ এলে তাঁদের সাথে কথা বলে নেবেন।"
"সিস্টার ওঁনার কিছু হবেনা তো?"
"আমরা তো আছি। ই.সি.জি. করতে হবে। একটু লাইন রয়েছে। আপনি নীচে অপেক্ষা করুন। দরকার হলে আপনাকে ডেকে নেব। চিন্তা করবেন না।"
"হুম। থ্যাঙ্ক ইউ। "আদিল ধীর পায়ে নীচে নেমে এল।
আকাশ ওকে দেখতে পেয়ে বলল, "সব হয়ে গেছে?"
"হ্যাঁ। বাড়িতে খবর দিতে বলল।"
একটু ইতস্তত করে আকাশ বলল, "আমাকে অফিসে ফিরতে হবে। তুই এদিকটা দেখতে পারবি?"
"একটু ক্ষণ থাকতে পারবি না?"
"অসুবিধা হবে রে।"
"ঠিক আছে। বেরিয়ে পর তাহলে।"
"থ্যাঙ্কস ইয়ার। কোনো প্রবলেম হলে কল করবি। "আকাশ বেরিয়ে গেল।
প্যাকেট থেকে সতুদার মোবাইলটা বের করে স্লিপমোড থেকে সেটা অন করল আদিল। লকস্ক্রিন ওয়াল পেপারে একটা ফ্যামিলি ফটো দেওয়া। দেখেই বোঝা যায় অনেক পুরোনো ফটো। সতুদা তখন অনেক ইয়াং। আঙুলে সোয়াইপ করে আনলক করতে ফোন খুলে গেল। হোমস্ক্রিন ওয়াল পেপারেও সেই একই ছবি।
আদিলের আবার সেই হিংসেটা হল। একবার মনে হল, ফোন করবেনা। এত সুখ তো ও কোনোদিন ওর পরিবারে পায়নি। তাই সতুদার জীবন থেকেও সেই সুখ কেড়ে নেবে। সতুদার এই অবস্থায় বাড়ির কেউ না এলে, উনি নিশ্চই রেগে যাবেন।
কিন্তু পর মুহূর্তেই বিবেকের দংশনে নিজেকে চড় মারতে ইচ্ছে হল ওর। কললগ ওপেন করে দেখল শেষ কল দুটো তিনে। লাঞ্চ করে তিনি ওয়াইফ কে শেষ কলটা করেছিলেন। আদিল সতুদার ফোন থেকেই সেই নাম্বারে কল করল। কিন্তু নাম্বার টা বিজি বলল।
দুবার - তিন বার চেষ্টার পরেও বারবার নাম্বার টা বিজি বলে গেল।
আদিল ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার কল করল। ভয়েস রেকর্ডারের মেয়েটি সেই একই কথা বলে গেল।
উপায় না দেখে সে নিজের মোবাইল থেকে নাম্বারটা ডায়াল করল। কল বাটনটায় চাপ দেবার সাথে সাথে থমকে গেল। স্ক্রিনে লেখা উঠেছে 'সতুদা'।
সতুদা তার ওয়াইফ বলে যে নাম্বারটা সেভ করে রেখেছে সেটা সতুদার নিজেরই নাম্বার। সেই জন্যই এতক্ষণ ধরে বিজি বলছিল। কিন্তু কেন?
আদিলের ভুরু ভীষণ ভাবে কুঁচকে গেছে। ও সতুদার কল লিস্ট চেক করল। আর ওর বুকে যেন হামান দিস্তার বাড়ি পড়ল।
সতুদার ফোনে অফিসের সায়ন, বড়বাবু সায়ক, আদিলের ফোন ছাড়া শুধু ফ্যামিলির সাথে যোগাযোগ হয়েছে। বৌ, ছেলে, ভাই সবাই কেই তিনি কল করেছেন। এঁদের কারোর থেকে কখনো কল আসেনি। আর এই প্রত্যেকটা মানুষের ফোন নাম্বার এক। আর সেটাই সতুদার নিজের ফোনের নাম্বার।
আদিল কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না। ওর মাথায় একই সঙ্গে অনেক এলোমেলো চিন্তা পাক খাচ্ছিল। একই নাম্বারের এত গুলো সিম তো কোনো সাধারণ মানুষ ব্যবহার করেনা। তাহলে কি সতুদা কোনো গন্ডগোলের সাথে জড়িত? কিন্তু তাও যে নাম্বারে দুপুর বেলায় উনি ফোন করে কথা বলেছেন, সেখানে এখন কল করলে বিজি কেন বলছে? তাহলে কি কথা বলার কোনো নির্দিষ্ট সময় আছে?
আদিল সায়ন কে ফোন করল।
"বলো।" সায়ন ফোন ধরে বলল।
"সতুদার বাড়ি কোথায় জানো?"
"সল্টলেকের ওদিকে কোথায় থাকে শুনেছিলাম।"
"ওঁনার ড্রয়ারটা দেখোতো একটু। একটা ডায়রি আছে। সেখানে বা অন্য কোথাও থেকে যদি ওঁনার অ্যাড্রেস পাও আমাকে হোয়াটস অ্যাপ করো সেটা। আমি ফোনে পাচ্ছি না। বাড়ি যেতে হবে।"
"ঠিগাছে একরা কাজ করচি। শেষ করে দেখছি।" ফোন কেটে দিল সায়ন। সতুদা কেমন আছে, জিজ্ঞেসও করল না।
'কাজ দেখানো' সায়ন ঘন্টা খানেকের আগে কিছু সাড়া দেবেনা। প্লাস, ছ'টায় ডাক্তারের সাথে কথা না বলে সে যেতে পারবে না। তাই ও ফোন দুটো পকেটে ঢুকিয়ে চুপ করে বসল।
*****
সি.এ.-৯৬, সি.এ. ব্লক, সেক্টর-ওয়ান, সল্টলেক। চারটের সময় ফোন করার উত্তর এল ছ'টার সময়। তার একটু পরই ডাক্তার এসে জিজ্ঞেস করলেন, "আপনি ওঁর কে হন ?"
"কলিগ।"
"ওঁর বাড়ির কেউ আসেন নি?"
"আমি ফোনে পাইনি। আপনার সাথে কথা বলে বাড়িতে খবর দেব।"
"ঠিক আছে। ওঁনার কিন্তু হাইপ্রেশার আছে। কিন্তু দীর্ঘদিন অবহেলা করে ফেলে রেখেছেন। নিয়মিত ওষুধ খাননা। যার জন্য এই অবস্থা। কপাল ভাল অফিসে হয়েছে। রাস্তা ঘাটে হলে তো কিছু বলা যেতনা। এনি ওয়ে, ই.সি.জি. করা হয়েছে। ওঁনার আর্টারিতে একটা প্যাথোলজিক্যাল চেঞ্জ হয়েছে। সেটাকে অ্যাথেরোস্ক্লেরোটিক চেঞ্জ বলে। অ্যানজিও করতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে ল্যাব খালি নেই। আমি পরশু হয়তো অ্যানজিও করতে পারব। তারপর দরকার বুঝে অ্যানজিওপ্লাস্টি করতে হবে। স্টেন বসাতে হবে।"
"উনি সুস্থ হয়ে যাবেন তো?"
"এখনই কিছু বলা সম্ভব না। কতটা ড্যামেজ হয়েছে সেটা বুঝে বলা সম্ভব। আমরা ভীষণ চেষ্টা করছি যাতে সেকেন্ড কোনো অ্যাটাক না হয়।"
"থ্যাঙ্ক ইউ ডক্টর।"
"হুম।" ডাক্তার বাবু চলে গেলেন। আদিল হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নিল।
সি.এ.-৯৬ একটা চারতলা অ্যাপার্টমেন্ট।গেটে কোনো সিকিউরিটি নেই। কিন্তু গেটের পাশে চেয়ার দেখে বোঝা গেল সিকিউরিটি আছে, তবে কাছে পিঠে কোথাও গেছে।
আদিল এগিয়ে গিয়ে কলিং বেলে এস.বাগচী দেখে বেল বাজাল। তিন তলায় সতুদার ঘর। কিন্তু কোনো উত্তর এল না। প্রায় পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে দশ বার বেল বাজিয়েও যখন কোনো সাড়া পাওয়া গেল না, বোঝা গেল বাড়িতে কেউ নেই। উপায় না দেখে আদিল ভেতরে ঢুকল। যদি প্রতিবেশী কারোর থেকে কোনো যোগাযোগ করা যায়।
তিন তলায় উঠে ডানদিকে ঘুরে প্রথম ঘরটার দরজায় নেমপ্লেট লাগানো সত্যেন্দ্র বাগচী। আদিল দরজার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বেল টিপল। উত্তর না পেয়ে দরজায় নক করল।
এমন সময় পিছন থেকে দরজা খোলার শব্দ পেয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে। একজন বছর পঞ্চাশের বেঁটে ভদ্রলোক দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছেন। আদিলকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, "বাড়িতে তো কেউ নেই। কাকে চাই?"
"নমস্কার।" আদিল দু'হাত জড়ো করে বলল, "আমি সত্যেন্দ্র বাগচীর অফিস থেকে আসছি। ওঁনার একটা মেডিকেল এমার্জেন্সি হয়েছে। মেডিকেল কলেজে ভর্তি আছেন। কিন্তু ওঁনার ছেলে, ওয়াইফ কাউ কেই ফোনে পেলাম না। ওঁরা বাড়িতেও নেই। কখন ফিরবেন জানেন?"
ভদ্রলোক পিছন ফিরে তাকালেন। তাঁর স্ত্রীর সাথে চোখাচোখি করলেন। ভদ্রমহিলা বললেন, "আপনি ভেতরে আসুন।"
আদিল ভেতরে ঢুকতে মহিলা একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বললেন, "বসুন।"
আদিল বসে বলল,"থ্যাঙ্ক ইউ। কিছু মনে করবেন না। আমার একটু তাড়া আছে। ওঁর ওয়াইফ বা ছেলের কোনো নাম্বার আছে? বা ওঁরা কখন ফিরবেন যদি বলেন.."
"সেই আশায় তো সত্যেনবাবুও বসে আছেন গত কুড়ি বছর ধরে।"
"মানে?"
"ওঁর ছেলে, মেয়ে কেউ ওঁর সাথে থাকে না। ছেলে থাকে সাউথ আফ্রিকা না অস্ট্রেলিয়া কোথায়। সেখানে গাড়ি-বাড়ি করে কোম্পানির একটা মেয়েকে বিয়ে করে রয়ে গেছে। বাপের খোঁজ সে করে না। সত্যেনবাবুর মা মারা গেছেন সে প্রায় বাইশ বছর হল। মারা যাবার আগে ওঁর ভাইয়ের বৌ আর ভাই মিলে ষড় করে সব সম্পত্তি নিজের নামে করে নেয়। সত্যেন বরাবরই ছিল ভালো আর সিধেসাধা সরল মানুষ। বারাসতের ওদিকে ওঁনাদের তিন পুরুষের আদিবাড়ি। অনেক জমি জমা। সব ভাই নিজের নামে করে নিয়ে দাদা কে লাথি মেরে ঘর থেকে বের করে দেয়। সেও প্রায় বিশ বছর আগের ঘটনা। ওঁর ছেলের তখন ছয় বছর বয়স, আর স্ত্রী রুক্মিণী তখন প্রেগন্যান্ট। সত্যেনের তখন মাথায় হাত। কোনো রকমে মধ্যমগ্রামের একটা রুমে ভাড়া নিয়ে থাকত। দু'হাজার চারে রুক্মিণী মেয়ের জন্ম দেয়। তারপরই সত্যেন কে ডিভোর্স করে দেয়। যে ছেলের হাতে সম্পত্তি নেই, টাকা নেই, পয়সা নেই তার সাথে কোনো মেয়ে থাকে? রুক্মিণীর বাবা আমাদেরই গ্রামের ছেলে। একবার চৈত্র মাসে গাঁয়ে গাজন আসে, সেই দেখতে গিয়ে শুনি এই গল্প। রুক্মিণী তো আবার বিয়ে করেছে। সত্যেন অনেক চেষ্টা করেছিল তাকে ফিরিয়ে আনতে। তার জন্য সল্টলেকে এই ফ্ল্যাটটা অবধি কিনল। কিন্তু রুক্মিণী আর ফেরেনি। ছেলে-মেয়ে নিয়ে সে নতুন বরের সাথে ব্যাঙ্গালোরে চলে যায়। কি একটা কাজে ছেলে একবার এসেছিল এখানে, সেও প্রায় ছয়-সাত বছর আগে। সেই প্রথম আর সেই শেষ দেখি আমি ছেলেকে। বাপের সাথে কি ঝগড়া। গায়ে হাত তোলে আর একটু হলে আর কি। কি জানি, মা হয় তো ছোট থেকে ছেলের মনে বাবার নামে বিষ ঢেলে গেছে। তাই বাপ কে সে সহ্য করতে পারে না।"
আদিল থ হয়ে বসে শুনছিল। ও কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না কোনো কথা। সারাদিন যে লোকটা ফ্যামিলি, ফ্যামিলি করে তার ফ্যামিলি বলে কিছুই নেই? ফ্যামিলির জন্য কোনো পার্টিতে যায় না, কোনো অনুষ্ঠানে আসে না। তার ফ্যামিলি কিনা...
"কিন্তু.." আদিলের মাথায় সব গন্ডগোল হয়ে যাচ্ছিল, "কিন্তু উনি যে ফোন করতেন ওয়াইফ কে।"
"শুধু ফোন না। ওয়াইফের জন্য পুজোয়, পয়লা বৈশাখে শাড়ি কেনেন, ছেলের জন্য জামা কেনেন। মেয়ের জন্য জিন্স, চুড়িদার, কুর্তি, ফ্রক কতকি কেনেন। আমাদের দেখান। এই তো গেল অক্টোবরে একটা শাড়ি এনে বললেন, "আমার ভাইয়ের বৌ যখন আমায় ফোঁটা দেবে, এটা দেব। কেমন হয়েছে?" ভদ্রলোকের চোখটা কেমন ছল ছল করে উঠল, "আমরা কি বলব বলো? বললাম সুন্দর হয়েছে। সারা জীবন ধরে লোকটা শুধু একটা হ্যাপি ফ্যামিলির সন্ধানে ঘুরেছে। পায়নি। তাই নিজের কল্পনায় একটা হ্যাপি ফ্যামিলি বানিয়ে নিয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হত বলে দি, কার জন্য কিনছেন? কেউ আছে আপনার? কেউ খোঁজ নেয়? মরে গেলে তো কেউ দেখতেও আসবেনা। কিন্তু তারপরই ভাবি, জীবনেতো কোনো সুখই পেলনা। মাথা বিগড়ে গিয়ে যদি একটু সুখ পায়, সেটুকু কেড়ে নেবার কোনো মানে হয়না। তাই কিছু বলিনি। আর কি ভীষণ ভাল রান্না করত... বলো?"
শেষ কথাটা ভদ্রমহিলার দিকে ঘুরে বললেন ভদ্রলোক। মহিলার গাল বেয়ে জল পড়ছে। কোনো উত্তর দিলেন না। ভদ্রলোক বললেন, "কিন্তু একদিন ও বলেন নিযে উনি নিজে রান্না করেছেন। খালি বলতেন, বৌ বানিয়েছে। চেখে দেখুন।" চোখ মুছে ভদ্রলোক বললেন, "সরল সিধে ভালো মানুষ বলে প্রত্যেকটা লোক ওঁকে ব্যবহার করে, নিংড়ে, চুষে ফেলে দিল। কেউ একবার ফিরেও দেখল না।"
মহিলা একটা প্লেটে কয়েকটা মিষ্টি আর জল এনে আদিলের দিকে এগিয়ে দিলেন। আদিল হাত নেড়ে বলল, "নানা। থাক। আমি উঠব।"
আদিলের পা চলছিল না। মাথাটাও ভীষণ ভারী লাগছিল। বেরোনোর সময় বিহ্বল গলায় বলল, "আপনাদের নামটাই জানা হল না। আমার নাম আদিল।"
"আমি সুভাষ। আমার মিসেস মিলি।"
"নমস্কার। আসি আমি।"
বাসে উঠে জানলার ধারে বসে আদিল চুপচাপ ভাবছিল। নিজেকে ভীষণ ছোট লাগছিল ওর। এই মানুষটা কে সে ঈর্ষা করত। তারতো তবু মা আছে, বোন আছে। নিজের বাড়ি টাকে এখন প্রাসাদ মনে হচ্ছিল তার। মা-র মুখটা ভীষণ মনে পড়ছিল। যার পরিবার নেই, সেই বোধ হয় জানে তার মূল্য কি। সে তো পরিবার থাকতে ও তার মূল্য দিতে পারেনি। ছোট-ঘর, মায়ের ময়লা শাড়ির লজ্জায় কাউকে কোনো দিন বাড়িতে আনতে চায়নি। কি এসে যায়, ঘরের দেওয়ালে তেল চিটে তো! কিই বা এসে যায় বোনের ফ্রকটা পুরোনো তো! মায়ের স্নেহ, বোনের আদর তো তাতে পাল্টে যায় না।
খান্নায় নেমে ও নিজের বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল। কাল কি হবে ও জানেনা। কিন্তু যদি সতুদা সুস্থ হয়ে ওঠেন, ও ওঁনাকে বাড়িতে নিয়ে আসবেই।